১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে অন্যান্য দলের সাথে চট্টগ্রাম শহরে ঢোকার পর পূর্ব নির্দিষ্ট বিভিন্ন স্থানে আমাদের ছেলেরা (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) বি.এল.এফ., কে.সি. ৩ (চট্টগ্রাম শহর কর্ণফুলী বাহিনী কে.সি. ৩) সদস্যবৃন্দ আশ্রয় নেয়। অপারেশনের পাশাপাশি বি.এল.এফ. প্রদত্ত দায়িত্ব অনুযায়ী শহরের যেখানে যেখানে সম্ভব সেখানে সেখানে স্থানীয় ছাত্র যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন নতুন গ্রুপ গঠনে আমরা মনযোগী হই। কে.সি. ৩ এর উদ্যোগে দেওয়ানবাজারে একটি গ্রুপ গঠন করা হয়। আজ এই গ্রুপটির কথা তুলে ধরবো।
কয়েকজনের সহায়তা নিয়ে জামাল খানের মনসুরকে খুজে বের করি। পুরোনাম আবুল মনসুর। পিতা এড. মনির আহমদ। মা’র নাম খুজে বের করতে পারিনি। যুদ্ধের সময় থাকতো মাছুয়া ঝর্ণা লেইনে তার নানা এড. মোফাক্কর আহমদের বাড়িতে। ওখানে মনসুরের ছোট বোনের স্বামী এডভোকেট মান্নান থাকতেন। মনসুর সেখানেই থাকতেন। মনসুর আগে ছাত্রলীগ করতেন। সেই সুবাদে পরিচয়। তাকে দেওয়ানবাজারের কিছু ছেলে বের করতে বলি যাতে তাদের ট্রেনিং দিয়ে গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত করানো যায়। কয়েকদিন পর আবারো যাই তার বাসায়। তিনি ততদিনে বাচ্চু ও তার ছোট ভাইকে খুঁজে পেয়েছেন। বাচ্চুর পুরো নাম রেজাউল করিম বাচ্চু। পিতা মো. এয়াকুব, মা’র নাম মোমেনা বেগম। থাকেন ১৭৫/এ মাছুয়া ঝর্ণা লেইন দেওয়ানবাজারে। মা-বাবার সাথেই থাকেন। বাচ্চুর ছোট ভাই তৌহিদুল করিম কাজল। এই তিন জনকে দায়িত্ব দেয়া হয় অন্তত ৭/ ৮ জনের একটি টিম গঠন করতে।
এরপর আমাদের গ্রুপের রকিবকে দায়িত্ব দেয়া হয় ট্রেনিং এর জন্য এবং প্রয়োজনে এই টিমের সাথে থেকে অপারেশন করার জন্য। রকিবের পুরো নাম রকিবুল হোসেন। পিতা আকবর হোসেন। মা’র নাম রেজিয়া খাতুন। যুদ্ধের সময় রেলওয়ের টি.পি.পি. কলোনীতে থাকতেন । এটি ছিল বিহারী অধ্যূসিত এলাকা। রকিবের পিতা আকবর হোসেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। রকিব বগাফা থেকে এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে এফ.এফ. গ্রুপ সদস্য হয়ে চট্টগ্রাম শহরে আমাদের সাথে ঢুকতে চেষ্টা করেছিলেন। এই গ্রুপটির কমান্ডের দায়িত্ব আমার উপর ছিল। সীতাকুন্ডে তখনো প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছিল। তাই আমাদের সাথে ভারতের পথে রওয়ানা হয়ে শুভপুর গিয়ে মেজর জিয়ার নির্দেশে শুভপুর প্রতিরোধ জড়িত হন। তিনদিন পর সেখান থেকে আমাদের সাথে রামগড় চলে যান। রামগড় প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ শেষে চলে যান বি.এল.এফ. এর আসামের হাফলং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সেখান থেকে ট্রেনিং নিয়ে আমাদের সাথে কে.সি. ৩ এর সদস্য হয়ে আমাদের সাথে চট্টগ্রাম শহরে ঢুকেন।
রকিব, মনসুর, বাচ্চুকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমি চলে আসি। এবার কাজ করার পালা ও আমাদের সাথে যোগাযোগ করার পালা রকিবের। কয়েকদিন পর মনসুর, বাচ্চু ও রকিব মিলে আসে আমাদের মুগলটুলি আশ্রয়কেন্দ্রে গরীবুল্লাহ মাতবরের বাড়িতে। জানায় তারা মোট ৮ জনকে নিয়ে একটি গ্রুপ গঠন করেছে। পরে আরো যুক্ত করার সম্ভাবনা আছে। কারা কারা যুক্ত হয়েছে তা জানতে চাইনি। এটাই নিয়ম। নিয়ম ছিল গ্রুপ গঠন করার পর যিনি এলাকার মূল সংগঠক তাকে চেনা এবং তার সাথে যোগাযোগ রেখে করনীয় ঠিক করে দেয়া। তিনজন জানালো গ্রুপের অপারেশন কমান্ডার হবেন বাচ্চু, সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করবেন মনসুর। রকিব মূল দলের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ট্রেনিং ও নির্দেশনা দিবেন। রকিবকে একটি স্টেনগান, একটি রিভলবার, কয়েকটি গ্রেনেড, বেশ কিছু পরিমান পিকে বিষ্ফোরক, প্রয়োজনীয় ডেটোনেটর, করডেক্স ও সেপটি ফিউজ দেয়া হল। আশ্রয় কেন্দ্রে আমার সাথে সে সময় সম্ভবত ছিল আমাদের গ্রুপের ফয়েজুর রহমান, জাফরউল্লাহ বোরহান ও গরীবুল্লাহ। গরিবুল্লাকে তার আশ্রয় কেন্দ্রেই ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল। গরীবুল্লাহ ও তার পুরো পরিবারের সহায়তায় আমরা আমাদের অস্ত্রের একটি বড় অংশ এখানে রাখতাম। অস্ত্র, বুলেট, বিষ্ফোরক তিনজনে ভাগ করে নিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে চলে গেল।
এই গ্রুপটির ট্রেনিং হয় মাছুয়া ঝর্ণা লেইনের একটি বাড়িতে এবং চন্দনপুরা মনু মিয়াজি লেইনের ভিতরে একটি কুঁড়ে ঘরে। কুঁড়ে ঘরটি ভাড়া নেয়া হয়েছিল। ট্রেনিং মানে কোন বাসায় বসে স্টেন গান, রিভলবার অংশগুলো দেখানো, ব্যবহারের কৌশলগুলো শেখানো, বিষ্ফোরক বানানো ও তা বিষ্ফোরণ ঘটানোর যাবতীয় কৌশলগুলো শিখানো। প্র্যাকটিক্যাল করানো সম্ভব ছিল না। প্র্যাকটিক্যাল হতো একেবারে টার্গেটে। রকিব গ্রুপটিকে ট্রেনিং দেয়। মনসুরসহ সবাই ট্রেনিং নেয়। রেজাউল করিম বাচ্চু মুসলিম হাই স্কুলে থাকতে ক্যাডেট ট্রেনিং, চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইউ ও টি সি থেকে আগেই ট্রেনিং প্রাপ্ত ছিলেন। যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে ধারণা ছিল। এই গ্রুপটি দেওয়ানবাজার ও আশে পাশের এলাকায় বেশ কয়েকটি অপারেশন করে। অপারেশনের সময় এই গ্রুপটির যখনই অস্ত্রের প্রয়োজন হতো রকিব এসে ফয়েজ বা বোরহানের সাথে যোগাযোগ করতো এবং গরীবুল্লাহ অথবা মাদারবাড়ির আবদুল আহাদ চৌধুরীর এখান থেকে বিষ্ফোরক বা এক্সপ্লোসিভ নিয়ে যেতো। গরীবুল্লাহ ও আহাদ চৌধুরী সম্পর্কে পরে বলা যাবে। মাঝে মধ্যে মনসুর,বাচ্চু ও রকিবের সাথে দেওয়ানবাজার গিয়ে দেখা করতাম। অপারেশন নিয়ে প্রয়োজনীয় আলোচনা হতো।
বলা প্রয়োজন শহরব্যাপী আমরা প্রধানত বিদ্যুতের স্থাপনা ও পেট্রোল পাম্পগুলোর উপর আঘাত করতাম বেশি। গেরিলা অপারেশনের মূল লক্ষ্যই ছিল পাকিস্তানিদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়া এবং জনগণের মনোবল চাঙ্গা করা এবং চাঙ্গা রাখা। শহরের এই দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছিল। হালকা অস্ত্র থাকতো আত্মরক্ষার জন্য আক্রমনের জন্য নয়। ভয় দেখানোর জন্যও ব্যবহৃত হতো। এই গ্রুপের সদস্যের কথা পরে মানে একেবারে স্বাধীনতার পর জেনেছি। এটাই স্বাভাবিক আগেই বলেছি। আমি চিনতাম ভারত থেকে আসা গ্রুপ সদস্যদের আর এলাকার মূল সংগঠক যোদ্ধাদের। এমনকি যে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে থাকতাম সেখানেও সবাইকে চিনতাম না। যিনি পরিবারের মূল আশ্রয়দাতা তাদের অবশ্যই চিনতে হতো। যুদ্ধের সময় চেনা-জানা বেশি থাকা বিপদজনক।
এই গ্রুপটির নেতৃত্ব দিয়েছেন রেজাউল করিম বাচ্চু, সংগঠক মানে সদস্যদের সাথে যোগাযোগ রাখা দেখা শুনার দায়িত্বে ছিলেন মনসুর আহমদ। রকিব মাঝে মধ্যে এদের সাথে নিয়ে অপারশেন করতেন। রকিবকে শহরের আরো স্থানে যেতে হতো। এই গ্রুপটি আরো যারা ছিলেন –
- মো আমানুল্লাহ, পিতা: নুর আহমদ, মা: তায়েবা বেগম, ঠিকানা: মোবারক মঞ্জিল, ৬০ সিরাজউদ্দৌলা রোড, দেওয়ান বাজার।
- তৌহিদুল করিম কাজল, বাচ্চুর ছোট ভাই, একই ঠিকানায় থাকতেন।
- মোস্তাফিজুর রহমান, পিতা: মহররম আলী, মা: জোবেদা খাতুন , ঠিকানা: ৩/১ দেওয়ারবাজার সি.এন্ড.বি কলোনী।
- আবু রায়হান চৌধুরী, পিতা: সুলতানুল আলম চৌধুরী, মা: ফারকুন্দা আলম, ১১ জামাল খান রোড, হেমসেন লেইন।
- দেলোয়ার হোসেন মন্টু, চট্টগ্রাম কলেজ প্যারেড ফিল্ডের বিপরীতে একটি পাকা ঘরে থাকতেন। এর বেশি তথ্য পাইনি।
- ওয়াহিদুল আলম, পিতা: শফিকুল হক চৌধুরী, মা: হাফেজা খাতুন, ৭১‘ সালে থাকতেন বড় ভাইয়ের বাসা: ১১৪ মোমিন রোডে। বড়ভাইয়ের নাম নুরুল আলম চৌধুরী। ওয়াহিদ হরিনা থেকে ট্রেনিং প্রাপ্ত হয়ে তাদের সাথে যুক্ত হন।
- তাজদিক, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের সার্জারী বিভাগের অধ্যাপক এ.এস. মিয়ার ছেলে। থাকতো বাবার সাথে। এর বেশি বর্তমানের তথ্য পাওয়া যায়নি।
- আরো ছিলেন বাবুল। ওর সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে পারেনি তার সাথীরা।
এই ১০ জনকে নিয়ে এই গ্রুপটি গঠিত হয়। তাদের অপারেশনের মাঝে ছিল:
- ফকা চৌধুরীর গুডস হিলের বাড়ির নীচের রাস্তার পাশে ট্রান্সফরমার উড়ানো। এতে ছিলেন রকিব, ফয়েজ, বোরহান, বাবুল।
- রহমতগঞ্জ পাওয়ার সাবস্টেশন ধ্বংস। এই অপারেশনে ছিলেন ফয়েজ, রকিব, বাচ্চু ও জাফরউল্লাহ বোরহান। সাবস্টেশনে বিষ্ফোরক বসানোর শেষে চলে আসার সময় সাবস্টেশনে পাহারারত এক মিলিশিয়া যোদ্ধাদের দিকে আসতে চাইলে তাকে খুন করে যোদ্ধারা।
- আসকার দিঘীর পাড়ে ট্রান্সফরমার বিষ্ফোরণ। এখানে ছিলেন রকিব, বাচ্চু, আমানুল্লাহ।
- ডিসি হিলের নীচে রাজাকারদের উপর গ্রেনেড চার্জ। এখানে ছিলেন বাচ্চু, আমানুল্লাহ, ওয়াহিদ ও কাজল।
- কোরবানিগঞ্জে ট্রান্সফরমার বিষ্ফোরণ। এতে ছিলেন বাচ্চু, আমানুল্লাহ, মুস্তাফিজ, ওয়াহিদ, দেলোয়ার হোসেন মন্টু।
- সি এন্ড বি কলোনীর সামনের ট্রান্সফরমার বিষ্ফোরণ। এখানে ছিলেন ফয়েজ, বাবুল, ওয়াহিদ, কাজল, মুস্তাফিজ।
- হেমসেন লেইন ট্রান্সফরমার বিষ্ফোরণ। এটা ঘটিয়েছেন বাচ্চু, আমানুল্লাহ, ওয়াহিদ, কাজল, রায়হান, বিষ্ফোরক স্থাপন করেছিলেন আমানুল্লাহ। বিষ্ফোরক স্থাপন করে ফিউজে আগুণ লাগানোর পর সবাই চলে যান। আমানুল্লাহ বাসায় গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। ৫ মিনিটের ফিউজ দেয়া হয়েছিল। মানে ৫ ফুটের ফিউজ লাগানো হয়েছিল যাতে ৫ মিনিট পর এটা বিষ্ফোরিত হয়। ৫ মিনিট পরও বিষ্ফোরণ না ঘটায় আমানুল্লাহ চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি আবার যান ঘটনাস্থলে। ঠিকমতো লাগানো হয়েছে কি না তা দেখার জন্য উপরে উঠতেই তিনি মৃদু তড়িত প্রবাহের কবলে পড়েন। দ্রুত নামতে গিয়ে তিনি নাকে আঘাত পান। রক্তাক্ত অবস্থায় বাসায় চলে আসেন। অনেক পর ওটা বিষ্ফোরিত হয়।
- চেরাগী পাহাড়ের মোড়ে ইউসিস লাইব্রেরীর সামনে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। একজন সিনেটর লাইব্রেরীতে আসবেন বলে খবর পান রকিব। বাচ্চুকে নিয়ে দ্রুত পরিকল্পনা কক্ষে কাজল, মুস্তাফিজ ও রায়হানকে পাঠানো হয়। তারা পর পর দুটি হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে চলে আসেন।
- গ্র্যান্ড হোটেলের পাশের গলির ভিতরে এক বিহারী কসাই এর বাড়ি ঘিরে তাকে মারধোর করেন বাচ্চু, কাজল, আমান, রায়হান, মন্টু, তাজদিক, বাবুল। ওখানে কিছু দেশীয় অস্ত্র পেয়ে ওগুলো নিয়ে আসেন তারা। ওই বিহারী এলাকায় দাপট দেখাতো। এরপর থেকে আর দাপট দেখায়নি।
- নভেম্বরের শেষ দিনে যৌথ কমান্ডের একই দিনে একই সময়ে সারা শহরে বিষ্ফোরণ ঘটানোর পরিকল্পনায় এই গ্রুপ জামালখান খাস্তগীর স্কুলের সামনে ওয়াপদা কলোনীতে একটি ফিডার বিষ্ফোরণ ঘটায়। অংশ গ্রহণে ছিল বাচ্চু, ওয়াহিদ, রায়হান, তাজদিক। বাকি সদস্যরা ৪টি পয়েন্টে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে যৌথ কমান্ডের পরিকল্পনায় সামিল হয়।
- ডিসেম্বরের ১৬ তারিখের ১০টার দিকে বাসে করে পলায়নরত রাজাকারদের আক্রমণ করে এই গ্রুপের সবাই মিলে। পাল্টা আক্রমণে সিরাজউদ্দৌলা রোডে মাছুয়া ঝর্ণা লেইনের মুখে দাড়িয়ে থাকা ছোট ছেলে রফিকের পায়ে গুলি লাগে। আর কেউ হতাহত হয়নি।
- বাচ্চু ও মনসুরের সহায়তায় কেসি ৪ দলনেতা ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান, কে সি ৩ সদস্য ফয়েজুর রহমান, জাফরউল্লাহ বোরহান, ডা. সাইফুদ্দিন, রকিব জামালখানে গিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা থেকে পাক সহযোগী হয়ে যাওয়া ইউসুফকে অপারেশন করতে। রহমতগঞ্জ লেইনের ভিতরে আদালত খাঁ’র পুকুরে ইউসুফ মাছ ধরছিল। যোদ্ধাদের দেখে ইউসুফ পুকুরে ঝাপ দেয়। এরপর ধীরে ধীরে পুকুর পাড়ে এসেই মনসুরের পা জড়িয়ে ধরে। পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে জানায় তার বোনকে সাকা চৌধুরী বন্দী করে রেখেছে। এই কারণে সে সাকা চৌধুরীর সহযোগী হতে বাধ্য হয়েছে। মনসুর তাকে অন্যদের অমতে ছেড়ে দেন। মনসুর সেই অপারেশন টিমের ভিতর সবচাইতে সিনিয়র ছিলেন। ফলে অন্যরা তার সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। এর কিছুদিন পরই মনসুরের আশ্রয়স্থল ঘেরাও করে মনসুরকে আলবদর বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। তাকে আর ফিরে পাওয়া যায়নি । তিনি শহীদ হন। যুদ্ধের পর বাচ্চু ও ওয়াহিদ ৩ দিন কতোয়ালী থানার দায়িত্বে ছিলেন।
অপারেশনগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দিতে গেলে যা আসবে তা হলো : ১ জন টার্গেটে বিষ্ফোরক লাগিয়েছেন। তাকে সহায়তা করেছেন কেউ। বিস্ফোরক লাগানোর সময় অন্যরা পাহাড়া দিয়েছেন। যদি শত্রুপক্ষ দেখেন এবং সে যদি ১ জন হয় তবে প্রতিহত করতেন, বেশী হলে যিনি বিষ্ফোরক লাগাচ্ছিলেন তাকেসহ নিয়ে সবাই স্থান ত্যাগ করবেন। একটি অপারশেনের কৃতিত্ব অংশ গ্রহণকারী সবার এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে কমান্ডারের। সফলতা এবং ব্যর্থতা উভয় ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, যখনই কোন গ্রুপ অন্য কোন গ্রুপের কোন সদস্যকে ডাকতো তারা অপারেশনে চলে আসতেন যেমন এসেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আজিজ। ফয়েজ, বোরহান, ডা. সাইফুদ্দিনের অপারেশন এলাকা ছিল গোটা চট্টগ্রাম শহর। বন্দর, আগ্রাবাদ, পাহাড়তলী, কতোয়ালী, পাঁচলাইশ, আন্দরকিল্লা, চকবাজার, মাদারবাড়ীসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে এরা অপারেশন করতেন। দেওয়ানবাজার, জামালখানেও এসেছিলেন অপারেশনের কাজে। আরো উল্লেখ করা দরকার, দেওয়ানবাজার, রহমতগঞ্জ, জামালখান এলাকায় এই গ্রুপটিই যে অপারেশন করেছে তা নয়। এগুলো ছিল কেবল কে.সি. ৩ গ্রুপের অপারেশন। বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন সময়ে এই সব এলাকায় অপারেশন করেছে। যেসব স্থাপনায় এই গ্রুপের অপারেশনের কথা বলা হয়েছে একই স্থাপনায় ভিন্ন সময়ে অন্য গ্রুপের সদস্যরাও আঘাত করেছে।
আশ্রয় কেন্দ্র: এই গ্রুপের আশ্রয়স্থল ছিল তাদের নিজেদের বাসা। ওয়াহিদ তার বড়ভায়ের বাসায় থাকতেন। তিনি সহযোগিতা দিয়েছেন। অস্ত্র রাখা হতো বাচ্চুর বাসায়। তার মা-বাবা সব জানতেন। রায়হান তার মা কে জানিয়ে বাসায় অস্ত্র রাখতেন। গ্রুপের সদস্যরা জানান, তাদের আরো কয়েকজন সব সময় সহযোগিতা করতেন যাদের নাম মনে নেই। তারা অুনরোধ জানিয়েছেন এই প্রতিবেদন পড়ে তারা সাড়া দিবেন যাতে এই প্রতিবেদন পূর্ণতা পেতে পারে। তবে একটি সত্য বেরিয়ে আসে এই যোদ্ধাদের যুদ্ধ ও থাকা খাওয়ার ব্যাপারে। সবাই রহমতগঞ্জ, জামালখান ও দেওয়ান বাজারের বা আশেপাশের বাসিন্দা। থেকেছেন এবং খেয়েছেন নিজেদের ঘরে। বাবা-মা সবই জানতেন। তারা এটাও জানতেন ধরা পড়লে তাদের মারা যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। এলাকার অনেক লোক তাদের স্বাভাবিক ভাবেই চিনতেন। তারা তাদের ধরিয়ে দেয়নি। এটা মুক্তিযুদ্ধে জনসম্পৃক্ততার প্রমাণ দেয়।
বর্তমানে কে কোথায়: রকিব, রায়হান, মুস্তাফিজ কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা এবং নাগরিক। ওয়াহিদ যুক্তরাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা এবং নাগরিক। আমানুল্লাহ পরে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন, সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে অবসরে গিয়েছেন। বাচ্চু, কাজল উচু পদে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি শেষে অবসরে আছেন। তাজদিক, বাবুল, মন্টুর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। ফয়েজ, ডা. সাইফুদ্দিন, জাফরউল্লাহ বোরহান, ইঞ্জিনিয়ার আজিজসহ অন্যদের কথা পরে বলা হবে।
অবাক করা ব্যাপার হলো মনসুর শহীদের স্বীকৃতি পাননি। মো. আমানুল্লাহ ছাড়া আর কেউ সরকারি স্বীকৃতি পাননি। এমনকি ভারতের দুই জায়গা থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও কে.সি. ৩ মূল দলের সদস্য রকিবও নয়। জাফরউল্লাহ বোরহান, ডা. সাইফুদ্দিন, এমনকি কে.সি. ৪ দল নেতা ইঞ্জিনিয়ার আজিজও তালিকাভুক্ত নন। তাই সরকারের তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারই কেবল মুক্তিযোদ্ধা অন্যরা নয়, এই ধারণাটি মোটেও সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।
তথ্যসূত্র:
লেখকের বই ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত, বাঙালির জাতীয়বাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম ও সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকার।
নিলয় সেন
এককথায় দারুণ হয়েছে, তথ্য গুলো জানানোর জন্য ধন্যবাদ।
মুহম্মদ আমির উদ্দিন
বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা-আমরা তোমাদের ভুলবো না।