নোয়াখালীর তৎকালীন বেগমগঞ্জ বর্তমান সোনাইমুড়ি থানার কেরামত আলী চৌধুরী ও মেহেরুন্নেসার ঘরে বড় ছেলে জন্ম নেয় রহমত উল্যাহ চৌধুরী। তিন ভাই বোনের মধ্যে রহমত উল্যাহ চৌধুরী ছিলেন সবার বড়। ছোটবেলা থেকেই প্রগতিবাদী মানুষ ছিলেন রহমত উল্যাহ চৌধুরী। উল্লেখ্য ১৯৪৮ সালে ইস্টার্ণ পাবলিক রেলওয়ে এমপ্লয়িজ এসোসিয়েশন গঠিত হয়েছিল। তার প্রথম সভাপতি ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কিন্তু পাকিস্তান সরকারের ব্যপক নিপীড়নের মুখে তার কর্মকাণ্ড আস্তে আস্তে স্থিমিত হয়ে যায়। ১৯৪৯ সালে লাকসাম রেলওয়ে স্টেশনে শ্রমিদের এক সমাবেশ হয়। সে সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রমিক নেতা মাহবুবুল হক। তিনি সেখানে হাজার হাজার মানুষের সমাবেশে বলেছিলেন “এই পাকিস্তান সরকারের অধীনে শ্রমিকের অধিকার আদায় সম্ভব নয়, আমাদের শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে”। সে সমাবেশে মাহবুবুল হক সাহেবের কথা রহমত চৌধুরীকে প্রবল আকর্ষিত করে। যার ফলশ্রুতিতে তিনি শ্রমিক রাজনীতিতে সরাসরি মনোনিবেশ করেন। এরই প্রেক্ষিতে সে বছরই সমাবেশের কিছুদিন পরই গঠিত হয় ইস্টার্ন পাবলিক রেলওয়ে এমপ্লয়েজলীগ। দ্রুতই পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে সারাদেশে ৩০-৩২ টি শাখা গঠিত হয়। এই শাখা গুলো আবার কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশনায় চলত। ইস্টার্ন পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়েজ লীগের লাকসাম শাখার প্রেসিডেন্ট ছিলেন জনাব এম এ কাসেম। এই দিকে উক্ত সংগঠনকে পাকিস্তান সরকার কোন ভাবেই ভালো ভাবে নিচ্ছিলোনা। শ্রমিক একতা সৃষ্টি পাকিস্তান সরকারের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাড়ায়।
১৯৫০ সালে পাকিস্তান সরকারের তোপের মুখে পদত্যাগ করেন এম এ কাসেম। উনার পদত্যাগের পর অনেকেই পাকিস্তান সরকারের মামলা, হামলা, চাকুরীচ্যুত হবার ভয়ে এ দায়িত্ব নিতে অপারাগতা দেখায়। তখন লাকসাম জংশনে ১০-১২ হাজার কর্মচারী ছিলেন। তাদের সকলের সিদ্ধান্ত মতে পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়েজ লীগের লাকসাম শাখার সভাপতি হন তরুণ রহমত উল্যাহ চৌধুরী। জীবনের প্রথম শ্রমিক দায়িত্ব পান রহমত উল্যাহ চৌধুরী। খুব একটা স্বচছল পরিবারের সদস্য ছিলেন না রহমত উল্যাহ। ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং ৫২ সালে ফলাফল প্রকাশ করলে তিনি সেখানে উত্তীর্ণ হন। সে সময় ভাষা আন্দোলন জোরদার হয়। মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু তখন ফরিদপুর জেলে ছিলেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের প্রতি পুলিশের গুলিতে ছাত্ররা নিহত হবার ঘটনায় সারা দেশ তখন উত্তাল। কুমিল্লার টাউন হলে সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সভায় সংগ্রাম পরিষদের কর্মীদের সাথে বিপরীত চিন্তার একদল ছাত্রের সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে পুলিশ কুমিল্লা সরকারী কলেজের তৎকালীণ ভি.পি,জি এস, রহমত উল্যাহ চৌধুরী সহ ৬০-৭০জনকে থানায় বেধে নিয়ে যায়। ধীরে ধীরে মানুষ মুসলিম লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে। মূলত ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৮ সালের আয়ুব খানের মার্শালের আগ পর্যন্ত ইস্টার্ণ রেলওয়ে এমপ্লয়েজ লীগ যে সব আন্দোলন করেছে তা কেবল শ্রমিকদের আন্দোলন ছিলনা, তা ছিল রাজনৈতিক আন্দোলন এবং মুসলিম লীগের অত্যাচার থেকে মানুষকে মুক্তি দেবার এক দীর্ঘ প্রচেষ্টা। সে সময়ে পুরো পূর্ব পাকিস্তানের শ্রমিকদের একত্রিত করা থেকে শুরু করে শ্রমিক আন্দোলনের সৃষ্টি এবং আন্দোলনকে চরম পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। ইস্টার্ণ পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ এসোসিয়েশন ও লীগ। যদিও বিভিন্ন সময় নাম ও নেতৃত্ব পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু আন্দোলন একই ছিল।
১৯৬০ সালে সরকার ধর্মঘট কিংবা অবরোধ করা যাবেনা এমন কিছু শর্ত দিয়ে শ্রমিক আন্দোলনের সুযোগ আছে বলে ঘোষণা দেয়। শ্রমিকদের নায্য পাওনার দাবীতে ১৯৬৩ সালে ধর্মঘট ডাকা হয়। ১৯৬৩ সালে রহমত উল্লাহ চৌধুরী ধর্মঘটে গ্রেফতার হন। জেলখানা থেকে যেদিন মুক্তি পান সেদিন মুক্তি পেয়েই জেল গেইট থেকে চট্টগ্রামের লালদিঘীর ময়দানে ছয় দফার দাবীতে ডাকা সমাবেশে রহমত উল্লাহ চৌধুরী অংশ নেন। সে সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন চট্টলার অবিসংবাদিত নেতা এম এ আজিজ, জহুর আহমেদ চৌধুরী, কামাল উদ্দীন, ডা. সৈয়দূর রহমান চৌধুরী প্রমুখ। ইতোমধ্যে ধর্মঘট ডাকায় পাকিস্তান সরকার রহমত উল্লাহ চৌধুরীকে রেলওয়ে থেকে চাকুরীচ্যুত করেন। তাই সরাসরি আওয়ামীলীগ করা শুরু করেন রহমত উল্যাহ চৌধুরী। সে সময় চট্টগ্রাম শহর আওয়ামীলীগের সম্মেলনে সভাপতি জহুর আহমেদ চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক কামাল আবদূর রহিম এবং সে কমিটিতে রহমত উল্যাহ চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। ইতোমধ্যে কামাল আবদূর রহিম অসুস্থ হয়ে গেলেন। তখন ছয় দফা আন্দোলনের জন্য দেশ উত্তাল। বঙ্গবন্ধু যেখানেই সমাবেশ করতে যেতেন সেখাইনে উনাকে এরেস্ট করা হতো। এদিকে শহর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ডা. সৈয়দূর রহমান গ্রেফতার হলে শহর আওয়ামীলীগ নেতৃত্ব শূন্য হয়ে পড়ে। দলের এ কঠিন সময়ে রহমত উল্যাহ চৌধুরীকে চট্টগ্রাম শহর আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সাতদিন আগে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবীতে চট্টগ্রাম শহর আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে রহমত উল্যাহ চৌধুরী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এদিকে ৬৯ গণ আন্দোলনে পাকিস্তান সরকার কাবু হয়ে যায়। হাইকোর্টের রায়ে অন্যায়ভাবে চাকুরীচ্যুত যাদের করা হয়েছিল তারা তাদের চাকুরী ফিরে পেল। রহমত উল্যাহ চৌধুরী তার চাকুরী ফিরে পেলেন। তখন রহমত উল্যাহ চৌধুরী ছিলেন কেন্দ্রীয় ইস্টার্ণ পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়েজ এসোসিয়েশনে যুগ্নসাধারণ সম্পাদক। শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান এম এ মান্নান। চাকুরী ফিরে পাবার পর বঙ্গবন্ধু রহমত উল্যাহ চৌধুরীকে রেলওয়ে শ্রমিক লীগকে শক্তিশালী করার দায়িত্ব দেন।
১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ লালদীঘির ময়দানে চট্টগ্রাম শহর আওয়ামীলীগের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে রহমত উল্যাহ চৌধুরী অংশ নেন। ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে তাঁর বাসায় স্থানীয় মাইকে তিনি শুনতে পান বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। ২৬শে মার্চ সকালে রহমত উল্যাহ চৌধুরী তার গ্রামের বাড়িতে তার পরিবার নিয়ে চলে যান। নোয়াখালীতে কিছুদিন থেকে রহমত উল্যাহ চৌধুরী রিটার্ড ইপিআর, আনসার পুলিশ সদস্যদের একত্রিত করে নোয়াখালীর ডিসি’র সাথে সাক্ষাৎ করে কিছু রাইফেল এস এম জি অস্ত্র সংগ্রহ করে যুদ্ধে যান। তখনো পাকিস্তানিরা নোয়াখালী আসেনি। কুমিল্লার হাই স্কুলের মাঠে পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সে যুদ্ধে যোদ্ধারা পরাজিত হন। এরপর পুরোগ্রাম জ্বালিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। পরবর্তীতে ছোট্টাখোলা দিয়ে রহমত উল্যাহ চৌধুরী হরিণা ক্যাম্পে যান। সেখানে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন এবং ডিসেম্বরের ১৮তারিখ বাড়ি ফিরেন। ১৯৭৫এর ১৫ই আগষ্ট জাতির পিতাকে হত্যার মধ্যে দিয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলোকে নিশ্চুপ করে দেওয়ার এক চেষ্টা করা হয়। কিন্তু রহমত উল্যাহ চৌধুরী বরাবরই ছিলেন একজন স্হাসী যোদ্ধা। রহমত উল্যাহ চৌধুরীকে সভাপতি এবং হাবিবুর রহমান সিরাজকে সাধারণ সম্পাদক করে জাতীয় শ্রমিক লীগ গঠন করা হয়। তিনি শ্রমিকদের আধিকার আদায়ে পুনরায় কাজ শুরু করেন। ১৯৮২ সালে রহমত উল্যাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ পাঁচ দফার দাবীতে সারাদেশে রেলপথ, সড়ক পথ অবরোধ করে আন্দোলন সংগ্রাম করে। পরবর্তীতে রহমত উল্যাহ চৌধুরী শ্রমিকদের নিয়ে করা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তৎকালীন স্বৈরাচার এরশাদ সরকার পাঁচ দফা দাবীর পক্ষে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে আওয়ামীলীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা রহমত উল্যাহ চৌধুরীকে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক করেন। এ দায়িত্ব উনি পর পর কয়েকবার পান, নিষ্ঠার সাথে পালন করেন এই দায়িত্ব এবং শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে কাজ করে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
দলকে ভালোবেসে শ্রমিকদের ভালোবেসে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত করে যাওয়া তার কাজগুলো আজো মানুষ স্মরণ করে পরম শ্রদ্ধায়। বলা হয়ে থাকে রহমত উল্যাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে রেলওয়ে শ্রমিক লীগ ঐক্যবদ্ধ ছিল। আজকের রেলওয়ে শ্রমিকলীগের বিভক্তি সে সময় ছিলনা। উনার মৃত্যুর পর এ বিভক্তি আজো দৃশ্যমান। জীবনে কখনো জনপ্রতিনিধি হননি জনগনের ভালোবাসা নিয়ে রাজনীতি করে গেছেন মানুষের জন্য। জনপ্রতিনিধি হবার চেষ্টাও করেন নি। ছিলেন নেত্রীর প্রতি প্রবল আস্থাবান, দলের প্রতি দায়িত্বশীল। ২০০৪ সালের ১৭ই মে শ্রমিক সংগঠনের এই নেতা শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। উনার জীবদ্ধশায় উনার স্ত্রী দুই ছেলে ও তিন মেয়ে অজশ্র শুভাকাঙ্ক্ষী ও দলের কর্মীদের রেখে গেছেন। প্রতিবছর ১৭ই মে এ মহান মানুষটির মৃত্যু বার্ষিকী পালিত হলেও সারা বছর এই মানুষটির কথা শ্রমিকদের মুখেমুখে থেকে যায়।
রহমত উল্যাহ চৌধুরী একাধারে ছিলেন একজন ভালো বক্তা, একজন সাহসী রাজনীতিবিদ, ভালো মঞ্চ অভিনেতা। মানুষকে দেশের ক্রান্তিকালে নিজের সৃজনশীল কাজের মাধ্যেমে মঞ্চে ফুটিয়ে তুলতেন দেশের প্রকৃত পরিস্থিতি ও সংকটের কথা। মানুষকে নিয়ে রহমত উল্যাহ চৌধুরীর অনেক স্বপ্ন ছিল। পিতার সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে চলেছে রহমত উল্লাহ চৌধুরীর সন্তানেরা “জননেতা রহমত উল্যাহ চৌধুরী” ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। উল্লেখ্য গত বছরেই করোনা কালীন সময়ের ডিসেম্বরের ১তারিখ চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা আওয়ামীলীগের প্রাক্তন সভানেত্রী বেগম রহমত উল্যাহ চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন। বেগম রহমত উল্যাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে প্রেস রিলিজ দেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যা বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত ছিল।
নিজামুল হক
আল্লাহ চাচাকে জান্নাত দান করুক আমিন এবং পরিবারে সবাই কে সব সময় সুস্থ রাখুক।