২০২১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ ৫০ বছরে পৌঁছালো। এই সময়ে এসে আমরা যদি স্বাধীনতার আগে সেই ৪৭ সাল থেকে ৭১ সাল পর্যন্ত সময়ের ইতিহাসের দিকে তাকাই তবে দেখবো ৪৭-৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ৬৫ সাল পর্যন্ত সকল আন্দোলনে বড় বড় নেতাদের উপস্থিতি থাকলেও বঙ্গবন্ধুর সব আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল যে কোন নেতার চাইতে সক্রিয়। ৬৬ সালে ৬ দফা দেয়ার পর থেকে ৬৯ সালে তার মুক্তির আগ পর্যন্ত জেলে থাকলেও সব আন্দোলনের উপলক্ষ্য ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ৬৯ সাল থেকে ৭১ সালের ২৫ মার্চ তিনি ছিলেন একক নেতা। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে তার নামে। ৪৭ সাল থেকে ৭১ সাল পর্যন্ত সব আন্দোলনের যে সব লক্ষ্য ছিল এবং মুক্তিযুদ্ধেও যে সব আকাংখা ছিল তার নির্যাস তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন ৭২ সংবিধানের মূলনীতিতে। কিন্তু একই সাথে সংবিধানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোটিতে কোন ধরনের পরিবর্তন না আনায় স্বাধীনতার ৫০ বছরেও মূলনীতিতে বর্ণিত রাষ্ট্রের লক্ষ্যগুলোর একটিরও সঠিক বাস্তবায়ন হয়নি। বঙ্গবন্ধু তার জীবিত অবস্থায় আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারেন নি। মাঝখানে বিএনপি, জাতীয় পার্টির শাসনামলে রাষ্ট্রকে মূলনীতি থেকে সড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। এরশাদও তাই করেছেন তবে স্বশাসিত উপজেলা পদ্ধতি, জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি, ওষুধ নীতিকে স্বাধীন দেশের উপযোগী করতে চেয়েছিলেন, বাংলা ভাষা আইন করে বাংলা প্রচলনের চেষ্টা করেছিলেন, পারেননি। শেখ হাসিনা ক্ষমতা নেয়ার পর মূলনীতিগুলো বাস্তবায়নের চাইতে উন্নয়নের দিকে ঝুকেছেন। সন্দেহ নেই তার আমলে বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু সংবিধানের মূলনীতিগুলোর বাস্তবায়ন ঘটেনি। বলা প্রয়োজন সংবিধানে উলেখিত রাজনৈতিক কাঠামো, প্রশাসনিক কাঠামো, বিচার কাঠামোকে বহাল রেখে মানে দেশকে উন্নতির চরম শিখরে নেয়া সম্ভব হলেও সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রের লক্ষ্যসমূহ পুরণ করা সম্ভব নয়।
দেখা যাক ৭২ সংবিধানে রাষ্টের কি কি লক্ষ্য নির্ধারিত ছিল এবং বর্তমান অবস্থা কি?
*সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাষ্টের মুলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা মেনে নেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে আমাদের রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে। বিভিন্ন অনুচ্ছেদের মাধ্যমে আমাদের জাতীয় পরিচয়, আমাদের রাষ্ট্রের লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। যেমন-
*৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।
একেবারেই ষ্পষ্ট নির্দেশনা যা মানা রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামুলক। প্রশাসন, আদালত কেউ মানেনি। ১৯৭৫ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু অফিস আদালতের কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তা মানা হয়নি। উচ্চ শিক্ষা ও অফিস আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার সহজীকরণের জন্য ১৯৭৫ সালে এপ্রিল মাসে তিনি একটি অনুবাদ সংস্থা গঠন করে দিয়েছিলেন। অনুবাদ সংস্থা কিছু ইংরেজি শব্দের অনুবাদ করলেও বঙ্গবন্ধুর আমলে রাষ্ট্রে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। এর একটি কারণ ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রশাসন চলছিল মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস যারা পাকিস্তানের সেবা দিয়েছিল সেই প্রশাসন দ্বারা। এর সাথে মুক্তিযোদ্ধা কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তা যুক্ত হয়েছিল মাত্র। ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন হয়েছে। বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। একটি রিটের প্রেক্ষিতে বাংলাভাষা প্রচলন আইন বাস্তবায়নের জন্য ২০১৪ সালে হাইকোর্ট একটি নির্দেশনা দিয়েছে। আইন প্রনয়ন ও আদালতের নির্দেশের মাঝামাঝিতে সরকারি ও আধা সরকারি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে তাও সবক্ষেত্রে নয়। বলা চলে স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় সরকারি দফতরগুলোতে বাংলা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে মানে বাংলা সরকারি ভাষা হিসেবে কিছুটা স্বীকৃতি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু কি এটা চেয়েছিলেন? ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বাংলাকে সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এর প্রতিবাদে সেই সময়ের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘সরকারি ভাষা বলে আমরা কিছু বুঝি না। এই প্রস্তাব কুমতলবে করা হয়েছে। আমরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে দেখতে চাই।’ এরপর বাংলাকে সরকারি ভাষার বদলে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং তার বাস্তবায়ন ২০ বছর পিছিয়ে দেয়া হয়। বাংলাকে সরকারি দফতরগুলো ব্যবহার করছে জেনে আত্মতুষ্টির কিছু নেই। যে উচ্চ আদালত বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন সেই আদালতও কিছু ব্যতিক্রম বাদে তাদের রায় দিচ্ছেন ইংরেজিতে। আর সরকারি দফতরগুলো বাংলাকে সম্মান করছে ভাবতে খটকা লাগে। যে কোন প্রতিষ্ঠানের নামফলক বা সাইনবোর্ড স্থানীয় সরকারের কতৃর্ত্বে থাকে। প্রতিবছর এর জন্য স্থানীয় সরকার কর আদায় করে। সংশিষ্ট কর্মকর্তা যখন নামফলকের অনুমোদন দেন তখন নামফলকে কতটুকু বাংলা ও কতটুকু বিদেশী ভাষা থাকবে তার নির্দেশনা দেন না? যদি দিয়ে থাকেন তবে আইন ভেঙ্গে ইংরেজিতে নামফলক লেখা হয় কিভাবে? লেখার পর পর তা উচ্ছেদ হয়না কেন? এটাতো নিয়মিত কাজ।
কেবল মাত্র ইংরেজিতে নামফলক লেখা বেআইনী ও আদালতের নির্দেশের অবমাননামূলক কাজ। প্রকাশ্য দিবালোকে বুক ফুলিয়ে যে বেআইনী সাইনবোর্ডগুলো সগর্বে দাড়িয়ে আছে তা কি প্রশাসন বা পুলিশ প্রশাসন দেখছে না? এই সাইনবোর্ড উচ্ছেদ করা এবং সংশিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মালিকদের আইনের আওতায় নেয়াতো পুলিশ এবং প্রশাসনের নিয়মিত কাজ। আসলে আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা এর গুরুত্বই উপলব্ধি করেন না যেমন করেন না মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো রক্ষা করার গুরুত্ব। অনেক আদি আওয়ামী লীগ নেতা এবং মন্ত্রীর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামফলক বিশাল করে কেবল ইংরেজিতে লেখা। এই নেতারা ঘটা করে মুজিববর্ষ পালনে পিছিয়ে নেই।
উচ্চ শিক্ষায় বাংলা প্রচলনের কোন উদ্যোগ নেই। বিশ্বের সব উন্নত জাতি এখন তাদের মাতৃভাষায় সব বিভাগের সর্বোচ্চ শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। তাদের অফিস আদালত কর্মক্ষেত্রে সব জায়গায়ই তারা তাদের মাতৃভাষাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। আমাদের এখন জাপান, চীন, ফ্রান্স বা যে কোন দেশে কাজের জন্য যেতে হলে তাদের ভাষা শিখে যেতে হয়।
আমরা এখনো আকড়ে আছি ইংরেজি নিয়ে। এই ভাষা বৈষম্য গ্রাম ও শহরের ছেলে মেয়েদের মাঝে চাকরি বৈষম্য সৃষ্টি করছে। বিদেশি ভাষায় উচ্চ শিক্ষা নেয়ার আমাদের শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা ও সময়ের অপচয় ঘটাচ্ছে। আমাদের ছেলে মেয়েদের ইংরেজিতে দক্ষ হতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ইংরেজ বা বিদেশি যে কোন জাতির জীবনাচার বা সংষ্কৃতি অনুসরণের চেষ্টা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদেশি ভাষার ব্যবহার আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে পিছিয়ে দেবে তাতে সন্দেহ নেই।
সমস্যার সমাধান কোথায়? গত ৫ বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধাসহ চট্টগ্রামের ২০টি সংগঠন পথসভা করে, মিছিল করে, কালো কালি লেপন করে ইংরেজি সাইন বোর্ড সরিয়ে নামফলকের উপরের ৬০ ভাগে বাংলা ও নীচের ৪০ ভাগে বিজাতীয় যে কোন ভাষা ব্যবহারের আবেদন জানিয়েছে। এতে অনেক প্রতিষ্ঠান সাড়া দিয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন চেষ্টা করেছে এবং করছে। সাড়া তেমন নেই। এখন জনগণকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের এইসব দাবির সপক্ষে সভা মিছিল কালি লেপন, প্রয়োজনে কিছু ভাংচুরের পথ বেছে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর কি?
বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিতরই সংবিধানে ৩ নং অনুচ্ছেদ বাস্তবায়িত করা সম্ভব তবে এর জন্য প্রয়োজন হবে গণজাগরণের। এর বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করা গেলে তা হতো বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নিদর্শন এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন। কিন্তু তা হয়নি।
১০ অনুচ্ছেদে রয়েছে সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তির কথা (অনু: ১০)।
বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন প্রচলিত সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন যা ছিল অসম্ভব। সংসদীয় গণতন্ত্রের অপর নাম বুর্জোয়া মানে ধনীদের গণতন্ত্র। ধনীরা তাদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে কেন? এটা নিয়ে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের শক্তিশালী একটি পক্ষের সাথে তার বিরোধ হয়েছিল। অন্যপক্ষ চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দলের লোকদের নিয়ে একটি বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠিত হোক। একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠন করা হোক। বিপ্লবী সরকারের স্বীকৃতি সাপেক্ষে সেই কাঠামোকে অস্থায়ী সংবিধান বলে বিবেচনা করা হোক। দেশ বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে চলুক। সূত্র (১২ মে, ১৯৭২, দৈনিক ইত্তেফাক)। ১৩ মে, ১৪ মে, জুন, ৭২ সালে যথাক্রমে বঙ্গবন্ধুর অনুসারি ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি এই প্রস্তাবকে হটকারি আখ্যা দিয়ে এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে দেশে এক ব্যক্তির স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা হবে দাবি করে তা প্রত্যাখ্যান করে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নেয়। বঙ্গবন্ধু ফিরে যান বা যেতে বাধ্য হন প্রচলিত বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ধারায়, প্রচলিত রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ধারায়। ফলাফল হলো সদ্য স্বাধীন দেশে বিভিন্নমুখী অরাজকতা। অবশেষে বঙ্গবন্ধু বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ধারা থেকে ফিরে এসে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেন, বাকশাল প্রতিষ্ঠা করলেন, বৃটিশ পাকিস্তানি প্রশাসনিক কাঠামো বদলে দিয়ে নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করলেন। ততদিনে ৩ বছর পার হয়ে গেছে। এর মাঝে নতুন গড়ে উঠা নব্য ধনিক শ্রেণি সংগঠিত হয়ে গেছে। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত। বাকশাল পদ্ধতি আমেরিকার পছন্দ ছিল না। বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আমেরিকাও ততদিনে বাংলাদেশের বন্ধুতে পরিণত হওয়ার চেষ্টা করছে। বাকশাল পদ্ধতিকে তারা তাদের স্বার্থের প্রতিকুল মনে করে। এরা সবাই মিলে খন্দকার মুশতাকের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। সমাজতন্ত্র ও শোষণ মুক্তির স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়।
১২ অনুচ্ছেদে সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কতৃর্ক কোন ধর্মকে মর্যাদা দান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করার নির্দেশনা রয়েছে। এই নির্দেশের বাস্তবায়ন কম। কারণ প্রশাসনিক শৈতল্য। ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করা হয়েছে। এটাকে বাতিল করা দুঃসাধ্য।
১৩ অনুচ্ছেদে মালিকানার নীতিতে বলা আছে উৎপাদন যন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা, ও বন্ঠন প্রণালী সমুহের মালিক হবে জনগণ এই উদ্দেশ্যে ৩ ধরনের মালিকানা নির্দিষ্ট করা আছে। ক. রাষ্ট্রীয় মালিকানা খ. সমবায়ী মালিকানা গ. ব্যক্তিগত মালিকানা। রাষ্ট্র এখন ব্যক্তি মালিকানার পূজারী। বুর্জোয়া বিশেষ করে সরকারের উপর নির্ভরশীল বুর্জোদের রাষ্ট্রে এটাই স্বাভাবিক।
১৪ অনুচ্ছেদ মতে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব ছিল মেহনতী মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা। বর্তমান সরকার প্রধান এই শ্রেণির মানুষদের জন্য বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছেন। এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা তাদের শোষণ থেকে মুক্তি দিবে কোন উপায়ে?
১৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং জনগণের জীবন যাত্রার বস্তুগত ও সংষ্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন, যাহাতে নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়। (ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা। (খ) কর্মের অধিকার অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার। (গ) যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার এবং (ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার; অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্ব জনিত কিংবা বৈধব্য, মাতা পিতৃহীনতা বা বার্ধক্য কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আওতাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার। অর্থনৈতিক বিকাশ হচ্ছে তবে তা পরিকল্পিত কিনা তাতে সন্দেহ আছে। কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ। জরিপেই বলা আছে পরিবারের ভিতর কাজ করে মুজুরি পায়না এমন মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ১১ লাখ। আরো আছে ১ কোটি ৬ লাখ দিন মজুর যাদের চাকরির কোন নিশ্চয়তা নেই। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের হিসেবে বেকারের সংখ্যা তিন কোটি। বৃটিশ একটি সংস্থার মতে বাংলাদেশের ৪৭ ভাগ স্নাতক বেকার। বিশ্ব ব্যাংকের মতে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪.২ %। প্রতিবছর নতুন করে ১৩ লক্ষ মানুষ শ্রম বাজারে যুক্ত হচ্ছেন। আরেকটি প্রতিবেদন বলছে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির সংস্থান হচ্ছে না। যুক্তিসংগত মুজুরি বা যুক্তিসংগত বিশ্রামের কথা না হয় বাদই দেয়া গেল। সরকার যে বসে আছে তা নয়। বেকারত্ব কমিয়ে আনা দারিদ্রতা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় তা কতটুকু সফলতা পেয়েছে এটা নিয়ে প্রশ্ন করাই যায়।
১৬ অনুচ্ছেদে গ্রামীন উন্নয়ন ও কৃষিবিপ্লবের কথা উলেখ আছে। গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতীকরনের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমুল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার অঙ্গীকার আছে রাষ্ট্রের। এই ক্ষেত্রেও সরকারের চেষ্টা আছে কিন্তু সফলতা কতটুকু?
১৭ অনুচ্ছেদে অবৈতনিকও বাধ্যতামূলক শিক্ষা শিরোনামে একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের কথা বলা আছে। আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা আছে। স্বাধীনতার এতো বছর পর দেখা যায় বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা জোরদার হচ্ছে। আমাদের জাতীয় সংসদ এখনো পর্যন্ত রাষ্ট্রের এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য কোন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেননি।
১৯ অনুচ্ছেদে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র ওয়াদাবদ্ধ। এটা এখন সুদূর পরাহত।
২০ অনুচ্ছেদে ‘প্রত্যেকের নিকট হতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’—এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করবেন বলে উলেখ রয়েছে। বলা আছে রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করবে, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করতে সমর্থ হবে না। কাজ না করে যারা আয় করেন তারা এখন সমাজপতি।
২১ অনুচ্ছেদে সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য বলে উলেখ আছে। হচ্ছে উল্টো। জনগণই প্রজাতন্ত্র ও কর্মচারীদের তোষণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকিকরণের কথা বলা আছে। ৫০ বছরেও এটা হয়নি। সংবিধানে রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসেবে আরো অনেক কিছুর কথা আছে। কাগজে থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই।
প্রশ্ন হলো রাষ্ট্রের লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাধা কোথায়? কোন ব্যক্তি বা দল কি এর জন্য দায়ী? এর জন্য কি তাহলে বঙ্গবন্ধু, জে. জিয়া, জে. এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনা দায়ী? আমাদের রাষ্ট্রনায়ক বা দলগুলো কি তবে জনগণের মঙ্গল চাননি? বঙ্গবন্ধুও না? তিনিতো এই দেশের স্রষ্টা। আজীবন আপামর বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মুক্তি চেয়েছেন। তবে সবাই ব্যর্থ কেন? আসলে এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী কোন ব্যক্তি বা দল নয়, দায়ী আমাদের আমলা নির্ভর বৃটিশ পাকিস্তানি উপনিবেশিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো। স্বাধীন দেশের উপযোগী রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অভাবেই স্বাধীন দেশের ঘোষিত লক্ষ্য বাস্তবায়িত হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু তার মতো করে বাকশালি প্রশাসন চালু করে উপনিবেশিক কাঠামো ভাঙ্গতে চেয়েছিলেন, পারেন নি। এই কারণে তাকে জীবন দিতে হয়েছে। এখন কোন দল বা সরকারের এই কাঠামো বদল করার ইচ্ছা থাকলেও শক্তি নেই। কাঠামো ভাঙ্গার শক্তি আছে কেবলমাত্র জনগণের। জনগণ ক্রমে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের জন্য আন্দোলনের সূচনা করতে পারেন। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দুর্বল দিকগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরে জনমত সৃষ্টি করতে পারেন। এই আন্দোলন হবে দীর্ঘমেয়াদী। রাষ্ট্র ঘোষিত লক্ষ্যগুলো অর্জনে এর কোন বিকল্প নেই। বর্তমান কাঠামো বহাল রেখে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন আর আম গাছে কাঠালের আশা করা একই কথা হবে। আমাদের এই জাতীয় কাল্পনিক আশা থেকে বের হয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তনের চিন্তা ও এর পক্ষে ক্ষুদ্র্র ক্ষুদ্র আন্দোলন রচনাই হবে সঠিক কাজ। একসময় এইসব আন্দোলন থেকে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে উঠবে, জনগণ সম্পৃক্ত হবে এবং ক্ষমতাসীন সরকার তা মেনে নিতে বাধ্য হবে এমনটাই আশা করা যায়।
মন্তব্য করুন